জেবি টিভি রিপোর্ট : বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড। প্রায় ২১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে বাস করেন প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ। ইউরোপের দেশ ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড। প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দ্বীপ। ভবিষ্যতের বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যে এসব খনিজের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। এ ছাড়া আর্কটিক অঞ্চলে কৌশলগত ক্রমগুরুত্বপূর্ণ নৌ বাণিজ্যপথগুলোর পাশেই এই দ্বীপের অবস্থান।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ের কথা বেশ কয়েক দফায় বলেছেন। গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে চান তিনি। প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগ্রহও রয়েছে তাঁর। এ জন্য জোরেশোরে আলোচনা শুরু করছেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
গ্রিনল্যান্ডের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রহের বিষয়টি বুঝতে হলে বেশ খানিকটা সময় পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। তখন ১৯৪৬ সাল। কিছুদিন আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কিনতে তখনই একটি প্রস্তাব সামনে এনেছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিতে এগেদে ১৩ জানুয়ারি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও খনি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে কাজ করবে গ্রিনল্যান্ড। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেন এগেদে বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ড স্বাধীনতা চায়। এটি বিক্রির জন্য নয়।’
বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডেরিকসেন। ১৬ জানুয়ারি এ ফোনালাপে তিনি ট্রাম্পকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ভার গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীদের। তাঁরা সেটা নির্ধারণ করবেন।’ এমনটাই বলা হয়েছে। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয়।’
কোনো বিদেশি ভূখণ্ড কেনা কিংবা বলপ্রয়োগে অধিগ্রহণ করাটা একুশ শতকের বিশ্বের সঙ্গে একেবারে যায় না। যদিও গ্রিনল্যান্ডের বিষয়টি ট্রাম্পের আরেকটি আপত্তিকর পদক্ষেপের চেয়েও বেশি কিছু; ঘটনাক্রমে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করার কথাও বলেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের কাছে গ্রিনল্যান্ড লোভনীয় আবাসন ব্যবসার চেয়েও বেশি কিছু, যা তাঁর নজরে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
ট্রাম্প এবারই প্রথম গ্রিনল্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বললেন, এমনটা নয়। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে কথা বলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
ওই সময় ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডেরিকসেন গ্রিনল্যান্ড কিনতে ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর একে ‘হাস্যকর’ উল্লেখ করে ট্রাম্প ২০১৯ সালের নভেম্বরে পূর্বনির্ধারিত ডেনমার্ক সফর বাতিল করেন।
তখন নিজের প্রথম মেয়াদের তৃতীয় বছরে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কয়েক মাসের মধ্যে করোনা মাহামারি বিশ্বজুড়ে সবকিছুকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। তাই ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব তখন হালে পানি পায়নি।
এবার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই গ্রিনল্যান্ডের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন ট্রাম্প। এমনকি শপথ নেওয়ার আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে সরব ছিলেন তিনি। নিজের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রকে গ্রিনল্যান্ড সফরে পাঠিয়েছিলেন তিনি। যদিও এটাকে অবকাশকালীন ভ্রমণ বলা হচ্ছে।
শুধু তা–ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে আসা ডেনিশ পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। তিনি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়ও একই হুমকি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি নিয়ে ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানি করা ডেনমার্কের কোম্পানিগুলো।
গ্রিনল্যান্ডের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রহের বিষয়টি বুঝতে হলে বেশ খানিকটা সময় পেছন ফিরে তাকাতে হবে। তখন ১৯৪৬ সাল। মাত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কিনতে তখনই একটি প্রস্তাব সামনে এনেছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
গ্রিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা নিয়ে ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ডেনমার্কের মধ্যে সই হওয়া একটি চুক্তির আলোকে এটা করা হয়। ওই চুক্তির ফলে গ্রিনল্যান্ডে প্রথমবারের মতো সামরিক অবস্থানের সুযোগ পান মার্কিন সেনারা। তখন জার্মান সেনারা ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। গ্রিনল্যান্ডও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হামলার চরম ঝুঁকিতে ছিল।
ডেনমার্ক ১৯৪৬ সালে চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। তত দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ডেনমার্কের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুস্তাভ রাসমুসেন বলেছিলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক ঋণী। তবু আমি মনে করি না, আমরা পুরো গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের জন্য তাদের কাছে ঋণী।’
পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু চুক্তির আওতায় গ্রিনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেশি প্রবেশাধিকার দিয়েছে ডেনমার্ক। কাজেই মার্কিনরা গ্রিনল্যান্ডে পুরোপুরি বহিরাগত নয়। গ্রিনল্যান্ড ও বিস্তৃত আর্কটিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো অবস্থান ও স্বার্থ রয়েছে।
১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন সেটা করা হয়েছিল নিরাপত্তা বিবেচনার নিরিখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্কটিক অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ‘কমাতে’ গ্রিনল্যান্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন।
১৯৪৬ সালের ওই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দাবির সপক্ষে ‘আধুনিক অস্ত্রের’ আবির্ভাবের কথা উল্লেখ করেছিল। পরবর্তী সময়ে চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সেখানে শুধু সামরিক ঘাঁটি গড়েনি; বরং একটি পারমাণবিক চুল্লি ও পারমাণবিক বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য একটি স্থাপনাও বানিয়েছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর উত্তরসূরি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা অনেকাংশেই শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন কেন ট্রাম্প আবার গ্রিনল্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পুরোনো অভিপ্রায় সামনে আনলেন? আর্কটিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলার অভিপ্রায় থেকে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আগেই বলা হয়েছে, গ্রিনল্যান্ড প্রাকৃতিক খনিজসমৃদ্ধ দ্বীপ। বিশেষ করে সোনা, নিকেল, কোবাল্টের মতো প্রচলিত খনিজের বড় মজুত রয়েছে এখানে। এ ছাড়া ডিসপ্রোসিয়াম, নিওডিয়ামিনিয়াম আর টারবিয়ামের মতো অপ্রচলিত খনিজের (আর্থ মিনারেল) বৃহৎ মজুত রয়েছে। ৩৪টি নিবন্ধিত অপ্রচলিত খনিজের মধ্যে গ্রিনল্যান্ডে রয়েছে প্রায় ২৩টি। খনিজের এই মজুত দ্বীপটির প্রতি কয়েকটি অনুসন্ধানী খনি কোম্পানিসহ অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
গ্রিনল্যান্ডের শুধু খনিজ শিল্পেই চীনা উপস্থিতি সীমিত নয়। আর্কটিক অঞ্চলে উচ্চাভিলাষী অভিযান পরিচালনা করছে চীন। সেই সঙ্গে দেশটি আর্কটিক অঞ্চলের সমুদ্রপথের বৃহত্তর ব্যবহার সহজ করার জন্য দ্বীপটিতে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত, নতুন নতুন সামরিক সরঞ্জাম এবং ইলেকট্রনিকসের ভোক্তা বাজারে উদীয়মান প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অপ্রচলিত খনিজের গুরুত্ব হঠাৎই বেড়ে গেছে। গ্রিনল্যান্ডের বাইরে চীনে এসব খনিজের মজুত ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূত। কাজেই এসবের বৈশ্বিক উত্তোলন ও সরবরাহের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ চীনের কবজায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গ্রিনল্যান্ডে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে বেইজিং। চীনা কোম্পানিগুলো সেখানে খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, খনন ও প্রক্রিয়াকরণে সক্রিয়ভাবে জড়িত। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ শিল্পে বিনিয়োগের ১১ শতাংশ বর্তমানে চীনের হাতে রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের অবস্থান।
গ্রিনল্যান্ডের শুধু খনিজ শিল্পেই চীনা উপস্থিতি সীমিত নয়। আর্কটিক অঞ্চলে উচ্চাভিলাষী অভিযান পরিচালনা করছে চীন। সেই সঙ্গে দেশটি আর্কটিক অঞ্চলের সমুদ্রপথের বৃহত্তর ব্যবহার সহজ করতে দ্বীপটিতে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে।
২০১৮ সালে নিজেদের আর্কটিক নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে বেইজিং। তাতে বলা হয়েছে, এশিয়া ও ইউরোপে উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ‘পোলার সিল্ক রোড’ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে চীনের।
চীনের এসব উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই হতাশ। এমনকি ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে দ্বীপে খুব বেশি চীনা কোম্পানিকে কাজের অনুমতি দেওয়া থেকে ডেনমার্ককে বিরত রাখার চেষ্টাও করা হয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনের চেষ্টার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বারবার দ্বীপটি নিয়ে আগ্রহ দেখানোর বড় কারণ গত এক দশকে এখানে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি।