আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামির ৩০০ আসনে নির্বাচন এবং পঞ্চম সংসদে ১৮টি আসন থেকে ধপ করে মাত্র ৩টি আসনে নেমে আসার ঘটনায় এখনো আমার ‘টম এন্ড জেরি’ কার্টুনে জেরিকে বেকায়দায় ফেলে ‘টম’ যেমন গড়াগড়ি দিয়ে হাসে এবং ‘টম’কে বিপদে ফেলে ‘জেরি’ যেমন হেসে লুটেপুটি খায়, আমারও তেমন হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি সাধারণত মুখ খুলে হাসি না। আমি ‘তানহা’ (নি:সঙ্গ) ও ‘হুজুন’ (বিষন্ন) এর মধ্যে থাকতে পছন্দ করি এবং এর মাঝে আনন্দ উপভোগ করি।
৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইশারা বা ‘আকল’ (বুদ্ধি) কোন মহল বা কোন গগন থেকে এসে ধরাধামে জামায়াত নেতাদের ওপর ভর করেছিল, তা একমাত্র আলিমুল গায়েব জানেন। ওই নির্বাচনে জামায়াত যদি ঐশী প্রত্যাদেশ পালন থেকে একটু ‘গোমরাহ’ হতো এবং ৩০০ আসনে নির্বাচন না করে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করতো, তাহলে পঞ্চম সংসদে (মার্চ ১৯৯১) তারা যে দুই সংরক্ষিত নারীসহ ২০ আসন পেয়েছিল, তা থেকে ৩ আসনে নেমে আসতে হতো না। বিএনপি-জামায়াত এক হয়ে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে যে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না, তা যে কোনো অন্ধ বা বিচার-বুদ্ধিহীন পাগলও বোঝে। কিন্তু জামায়াত বোঝেনি। জামায়াত “ঝি মেরে বউকে শাসন” করতে চেয়েছিল। অতএব, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার সকল কৃতিত্ব ছিল জামায়াতের।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে জামায়াত কি কারণে দূরে চলে গিয়েছিল? প্রধান কারণ: ‘গোলাম আজমকে বিএনপি নাগরিকত্ব ফিরিয়ে না দিয়ে বরং তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল। বিএনপির প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও জামায়াত যেহেতু বিএনপির সঙ্গে সরকারে যোগ দেয়নি, সম্ভবত সে কারণে ওই বছরের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে সমর্থন চেয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে জামায়াতের আমীর (অঘোষিত) গোলাম আজমকে জায়নামাজ ও তসবিহ উপহার প্রেরণ, গোলাম আজমের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর সাক্ষাৎ ইত্যাদি সত্ত্বেও জামায়াত বিএনপির প্রেসিডেন্ট প্রাথী আবদুর রহমান বিশ্বাসের পক্ষেই ছিল। তা না হলে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। জামায়াত যদি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন করতো তাহলে ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ ৮৮ + জাতীয় পার্টি ৩৫ + জামায়াতে ইসলামী ২০ + কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ৫ + সিপিবি ৫ = ১৫৩ ভোট পেতে পারতেন বদরুল হায়দার চৌধুরী। বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল ১৪০। জামায়াতের অনুকুল সাড়া না পেয়ে আওয়ামী লীগ তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে এবং বিএনপির প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
কিন্তু ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে গোলাম আজমকে গ্রেফতার করার কারণে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তা আর ঘোঁচেনি। আমার রাজনৈতিক বৃদ্ধি একেবারেই নেই। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে রাজনীতর যেটুকু বুঝেছি এবং সাংবাদিকতা করার কারণে যে অভিজ্ঞান লাভ করেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, বিএনপির ওপর জামায়াতের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের কারণেই জামায়াতের উচিত ছিল ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সমর্থন করা এবং ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে উচিত ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাথীকে ভোট দেওয়া এবং সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী গাঁটছড়া বাঁধা। প্রকাশ্যে না হলেও অপ্রকাশ্যে হতে পারতো। রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলে মানুষের মন যেমন নরম থাকে, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিলের ভেতরও আল্লাহ রহম পয়দা করেন। রাজনীতিতে কে স্থায়ী বন্ধু, আর কে স্থায়ী শত্রু! দেখার বিষয় হলে, আখেরে কোনটায় লাভ বেশি! একটা বাউল গান আছে:
“বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা,
হরেক রকম পাগল দিয়া মিলাইছো মেলা।”
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে যারা অভিনেতা অভিনেত্রী, তারা অনেকে অনেক বেশি বোঝেন। আজ থেকে নয়, সুদূর অতীত থেকেই বাঙালি বেশি বুদ্ধিমান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতা রাম কৃষ্ণ গোখলে বাঙালি না হয়েও বাঙালির বিদ্যাবুদ্ধি, সাহসিকতা, শৌর্য বীর্যের প্রশংসা করতে অথবা তোষামোদ করতে বলেছিলেন, “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, দ্য রেস্ট অফ ইন্ডিয়াা উইল থিঙ্ক ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস লেটার।” কিন্তু জামায়াত নেতরা বাঙালি হলে আল্লাহ ইশারায় লেফট রাইট করা ছাড়া তাদের মাথায় বুদ্ধির ঘিলু কম দিয়েছেন অথবা আদৌ দেননি। এই ঘিলুর অভাবে তারা গত দেড় দশক যাবত যে বিপদে পড়েছেন, তা নাও পড়তে পারতেন। আগে তাদের “হিকমত” এর কথা শুনতাম, এখন “হিকমত” এর সেই দরজা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা, তা সর্বজ্ঞানের আধার আল্লাহই জানে। তাদের “হিকমত” আর কাজে লাগছে না। তবে জীবদ্দশায় যেটুকু দেখার সুযোগ হলো, মৃত্যুর পর যা হতে পারে, জামায়াত নেতারা একটি অংশের অভিজ্ঞতা তারা দুনিয়াতেই দেখছেন।
জামায়াতের উচ্চাভিলাষী ১৯৯৬ এর নির্বাচনে বাংলাদেশে “খিলাফতে মুসলেমিনে বাংলাদেশ অথবা আল্লাহর হুকুমত “বাংলাদেশ ইসলামিয়া জমহুরিয়া” কায়েমের স্বপ্ন কীভাবে ব্যর্থ হলো এবং তাদের উচ্চাভিলাষের শিকারে পরিণত হলো বিএনপি এবং লাভের ফসল আহরণ করল আওয়ামী লীগ, তার পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরার আগে একটি “শানে নজুল” বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরছি:
শানে নজুল:
কেয়ারটেকার’ সরকারের অধীনে সুষ্ঠূ, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে চ্যালচ্যালায়া ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে যে “বাংলাদেশ ইসলামিয়া জমহুরিয়া” কায়েম করা যাবে, এ সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর আমির-ওমরাহদের কোনো আন্দেশা (সন্দেহ) ছিল না। ১৯৮১ সাল থেকে তারা কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার ‘জিকির’ (চর্চা) শুরু করে। এরপর শুরু করে জিহা। এ জিহাদে শাহাদাতের পিয়ালা পান করতে তারা রাজপথ দাপিয়ে বেড়াত। উল্লেখ করেছি যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি কেয়ারটেকার সরকারের কোনো সাংবিধানিক ধারণার সঙ্গে কখনোই পরিচিতি ছিলাম না। বাংলাদেশ যেসব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থা অনুসরণ করে, সেইসব দেশ — যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট এবং এমনকি বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতেও এমন উদ্ভট কাঠানো নেই। এসব দেশ ছাড়াও গোটা দুনিয়ায় সকল দেশে বিদ্যমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মানুষ তো আর ফেরেশতা নয়, তাই আমাদের মতো দেশে নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের কর্তারা সকল আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষের সহজাত অভ্যাস অনুযায়ী অনুষ্ঠান করেন। জনপ্রিয় বিরোধী দলের ললাটে ভালো কিছু লেখা না থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি দলই পুন:পুন: নির্বাচিত হওয়ার সুবিধা লাভ করে।
আওয়ামী লীগ ভেতরে ভেতরে কেয়ারটেকার সরকার না চাইলেও তারা বিএনপি সরকারকে কুপোকাৎ করার উদ্দেশ্যে এই অভিনব ব্যবস্থার দাবীতে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক বিবেচনা করে। তারা জামায়াতের কেয়ারটেকার ইস্যুকে নিজেদের ইস্যুতে পরিণত করে এবং এই দাবীতে সূচিত আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দেয়। আন্দোলনে নতি স্বীকার করে বিএনপি সরকার এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হয়েছিল। এ টুকুতেই জামায়াতের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিল যে তাদের একটি ইস্যুকে দেশের স্বাধীনতা কৃতিত্বের অধিকারী দল নিজেদের করে নিয়েছে। তা আওয়ামী লীগ অফিসিয়ালি স্বীকার করুক আর না করুক।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘ ইতিহাসে তারা কোনো কিছুতে সন্তুষ্ট হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। মাওলানা মওদুদী ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ এবং দেওবন্দের ওলামাদের সঙ্গে সমস্বরে জামায়াতে ইসলামী জিন্নাহ’র দ্বিজাতি-তত্ত্বের প্রবল বিরোধিতা এবং হিন্দু -মুসলিম সম্প্রদায় ভিত্তিক ভারতে বিভক্তির বিরোধিতা অবর্তীর্ণ হন এবং অখ- ভারতের পক্ষে ভূমিকা রাখেন। নি;সন্দেহে তা ওপরওয়ালার ইশারায়। এমনকি পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটিও জামায়াত সমর্থন করেনি। তারা কখনো “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”আওয়াজ তোলেনি।
কিন্তু তারা ওপরওয়ালার ইশারা বোঝেন কি বোঝেন না, তা আমার বোধগম্য নয়। ৫০ বছর আগেও বুঝিনি, এখনও বুঝি না। তবে এটা জানি যে, ঐশী ইঙ্গিত সবাই বোঝে না, ভুলভাবেও বোঝে। আড়াই হাজার বছর আগে পারস্যের সম্রাট সাইরাস নৌপথে গ্রিক সম্রাট জেরাক্সেস এর বাহিনীর ওপর হামলা করেন। নগরবাসী দৌড়ে যায় গণক ডেলফির কাছে। যুদ্ধে কে বিজয়ী হবে? ডেলফির জবাব ছিল, “একটি বড় শক্তির পতন হবে।” নগরবাসী ধরে নেয় জেরাক্সেস জয়লাভ করবেন। কিন্তু যুদ্ধে সাইরাস জয়ী হন এবং জেরাক্সেস তার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেন।
জামায়াতের পাকিস্তান বিরোধিতার কারণে ভারত বিভক্তি আটকে থাকেনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও অখ- ভারতের সমর্থক হিসেবে জামায়াতের পাকিস্তান অংশের কেউ ভারতে হিজরতও করেননি। এবার আল্লাহর ইশারা ভিন্নরকম হলো,, জামায়াত পাকিস্তানের এমন পাবন্দ হলো যে, যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারাও বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করেছিলেন। যদিও পাকিস্তানের ২৪ বছরে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবদান প্রায় শূন্য, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য জান কোরবান করা এবং হিন্দুস্থানকে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে দেয়ার কথা জামায়াত নেতারা এত জোরে শোরে বলতেন যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকারী দল মুসলিম লীগও লজ্জা পেত।
পাকিস্তান আমলে জামায়াতের দর্শনের মধ্যে একটি ছিল: “নারী নেতৃত্ব হারাম।” আরেকটি ছিল: ইসলামী খিলাফতের আদলে “রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা।” কিন্তু ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ্েরপসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর চিরকুমারী বোন ‘মাদারে মিল্লাত’ ফাতিমা জিন্নাহ প্রাথী হলেন, তখন মাওলানা মওদুদী ও তার অনুসারীদের কণ্ঠে ও লেখাজোখায় নারী নেতৃত্ব কেন কীভাবে ও কত প্রকারে বৈধ ও ইসলাম সম্মত, তা জাতি জানতে পারল। জামায়াতের তাবড় তাবড় নেতারা পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী অভিযানে ফাতিমা জিন্নাহ’র শাড়ির আঁচল ধরে ধরে ঘুরলেন। আলহামদুলিল্লাহ! সকল প্রশংসা আল্লাহর, তিনি কতভাবে জামায়াত নেতাদের ইশারা দিয়ে ধন্য করেন এবং আমার মতো উম্মিরা (মূর্খ বা নিরক্ষর) কিঞ্চিৎ জ্ঞান আহরণের সুযোগ লাভ করি।
এরপরের পরিবর্তন জামায়াতের বোধোদয়। আল্লাহ যখন দলাটর নেতাদের ইশারাযোগে বোঝালেন যে, জামায়াত হাজার বছর কোশেশ করলেও সেই দলের কেউ পাকিস্তানের খলিফা অর্থ্যাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না, অতএব “শুরা” (মজলিস-ই-শুরা বা পার্লামেন্ট) নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু লোক নির্বাচিত হলে তারা অন্তত পার্লামেন্টে কিছু কথাবার্তা বলতে পারবেন।
যে জামায়াতে ইসলামী অখ- ভারতের জন্য পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রবল বিরোধিতা করেছে, সেই জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার জন্য যে ভূমিকা পালন করেছে, তা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। পাকিস্তান ্্আন্দোলনকারীরও পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন ছিল না, যতটা জামায়াত উদ্বিগ্ন ছিল। এমন পরিস্থিতিকেই বোধকরি বলা হয়: “মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।” অথবা জামায়াতের জন্য কি আল্লাহর ইশারা এত ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়? অথবা তারা কি আল্লাহর ইশারা বোঝেন না! “নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারীব” Ñবিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” জামায়াত কোরআনের বাণীর ব্যাখ্যা করে নিজেদের জন্য। কিন্তু আল্লাহ বিজয় দেন অন্যদের, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করল কি করল না, তা বিবেচ্য নয়। জামায়াত তবুও “কোরআনের আইন চায় ও সৎ মানুষের শাসন চায়।” চাইতেই পারে। কিন্তু একটু আগে বলেছি, আমি আগেও তাদের কথা বুঝিনি, এখনো বুঝি না। বরং এখন এসব কথাবার্তা শুনলে মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়।
গালিব আগ্রা থেকে দিল্লিতে এসে যখন পুরোদস্তুর কবি হয়ে উঠেছেন তখনো দিল্লির কবিরা তাকে তাদের পাশে জায়গা দিতে চাইছিলেন না। কবিরা এখনো তাই করেন, নিজেদের গ-িতে নতুন ভালো কবিকেও আশ্রয় দেন না। ওই সময় দিল্লিতে কবি ও শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষক শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে গালিব সম্পর্কে কটুক্তি করেন, যাতে বাদশাহ তাকে সান্ধ্য ‘মুশায়রা’য় আমন্ত্রণ না জানান। বাদশাহর পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হলে অবশেষে তারা বলেন: “শায়ের তো আচ্ছা হ্যায়, লেকিন বদনাম বহুত হ্যায়” Ñ কবি হিসেবে তো ভালো, কিন্তু তার অনেক বদনাম। এসময় আইশ দেহলভি নামে দিল্লির এক কবি গালিবকে বিদ্রুপ করে লিখেন:
“কালাম-ই-মীর সমঝে আউর জবাব-এ-মির্জা সমঝে,
মগর উনকা কাহা ইয়া আপ সমঝে ইয়া খুদা সমঝে।”
(মীরের কবিতা বুঝি, মির্জার কথাও বুঝতে পারি,
কিন্তু তার কথা তিনি নিজে বোঝেন, অথবা খোদা বোঝেন।)
একইভাবে জামায়াতের নেতানেত্রী ভাইবোনেরা হয় কোরআন-হাদিস বিধৌত অমীয় বাণী বোঝেন অথবা তাদের খোদাতা’য়ালা বোঝেন।
আমি ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনের ফলাফল প্রদর্শন করছি। ওই আসনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াতের প্রাথীদের প্রাপ্ত ভোটের যোগফল এবং ওই বিজয় লাভকারী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা দেখলেই পাঠকদের ‘বন্ধ আকল কা তালা’ (রুদ্ধ জ্ঞানের তালা) আরব্য উপন্যাসের “আলীবাবা চল্লিশ চোরের” গুহার ফাঁদ উন্মোচিত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ‘আকলমন্দ কে লিয়ে ইশারা কাফি’ — বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।’
(১) পাবনা -১: বিএনপি: ৬০,২১৩ + জামায়াত: ৪০,৭৯৫ = ১,০১,০০৮; আওয়ামী লীগ: ৭৩,৯৬০;
(২) পাবনা – ২: বিএনপি: ৬৫,৩৮২ + জামায়াত: ৩,৯৭০ = ৬৯,০৮৪; আওয়ামী লীগ: ৬৭,১১৪;
(৩) পাবনা – ৪: বিএনপি: ৫৫,৯৪২ + জামায়াত: ৩৫,৫৭৭ =৯১,৫১৯; আওয়ামী লীগ: ৬৬,৪১৫;
(৪) পাবনা – ৫: বিএনপি: ৪০,৬২৫ + জামায়াত: ৩২,২৭৯ = ৭২,৯০৪; আওয়ামী লীগ: ৪৬, ১০৫;
(৫) নাটোর – ৪: বিএনপি: ৬১,৩৭৬ + জামায়াত: ১২,৯৩২ = ৭৪,৩০৮; আওয়ামী লীগ: ৬৭,০০৮;
(৬) সিরাজগঞ্জ — ২: বিএনপি: ৫২,৫৯৫ + জামায়াত: ২২,৭৮৮ = ৭৫,৩৮৩; আওয়ামী লীগ: ৬৮,৫৯৫;
(৭) যশোহর -১: বিএনপি: ৪৮,৩৬০ + জামায়াত ৩৪,৫২৬ = ৮২,৮৮৬; আওয়ামী লীগ: ৮০,৪৭৬;
(৮) যশোহর –২ বিএনপি: ৫৮,৪০৩ + জামায়াত: ৪৮,৩৮৮ = ; ১,০৬,৭৯১; আওয়ামী লীগ: ; ৮৬, ৭৪৮;
(৯) যশোহর — ৩: বিএনপি: ৬৫,৫৯৩ + জামায়াত: ১৯,৩২০ = ৮৪,৯১৩; আওয়ামী লীগ: ; ৭৫,৮৫৭
(১০) মাগুরা — ২: বিএনপি: ৫৫,১৯৮ + জামায়াত: ১০,৫৭৮ = ৬৫, ৭৭৬; আওয়ামী লীগ: ৬৪,১৮৩;
(১১) নড়াইল — ২: বিএনপি: ৪২,৭১৫ + জামায়াত: ২২,০৮৪ = ৬৪, ৮০৩; আওয়ামী লীগ: ৬৩,৯০৮;
(১২) বাগেরহাট — ২: বিএনপি: ৫১,৪২৬ + জামায়াত: ২৬,৭৯২ = ৭৭,২১৮; আওয়ামী লীগ: ৫৭,৩৬৯;
(১৩) বাগেরহাট — ৩: বিএনপি: ২১,৫৫০ + জামায়াত: ৩৪,৩২১ = ৫৫,৮৭১; আওয়ামী লীগ: ৫২,৪৪৫;
(১৪) খুলনা — ৩: বিএনপি: ৩৭,৩২২ + জামায়াত: ৭,৮৯৬ = ৪৪,২১৮; আওয়ামী লীগ: ৩৯,৩২২;
(১৫) খুলনা– ৪: বিএনপি: ৫৭,২১৬ + জামায়াত: ১২,৭০৯ = ৬৯,৯২৫; আওয়ামী লীগ: ৫৯,৫৭৪;
(১৬) সাতক্ষীরা–১: বিএনপি: ৩৯,৬১০ + জামায়াত: ৫১,০৫৪ = ৯০,৬৬৪; আওয়ামী লীগ: ৭৬, ৭১৫;
(১৭) সাতক্ষীরা –৫: বিএনপি: ১৩,৯০১ + জামায়াত: ৩১,১৭১ = ; ৪৪,৯৭২; আওয়ামী লীগ: ৪০,৭২৫ ;
(১৮) পটুয়াখালী–২: বিএনপি: ৪৫,৯০৩ + জামায়াত: ১,৬৭৯ = ৪৭,৫৪১; আওয়ামী লীগ: ৪৫,৯৩২;
(১৯) সুনামগঞ্জ-১: বিএনপি: ৬৭,৩১২ + জামায়াত: ৯.৮৭৬ = ৭১,১৮৮; আওয়ামী লীগ: ৬৮,৭৮৭;
(২০) সুনামগঞ্জ –৫: বিএনপি: ৩৩,৮৭৫+ জামায়াত: ১০,০৬৭ = ; ৪৩,৯৪২ আওয়ামী লীগ:৪৩,০৩৯;
(২১) সিলেট -১: বিএনপি: ৫৮,৯৯০ + জামায়াত: ১৮,০২৯ = ৭৭,০১৯; আওয়ামী লীগ:৫৯,৭১০;
(২২) সিলেট –২: বিএনপি: ৩৮,৪৭৩ + জামায়াত: ৬,৩৮২ = ৪৪,৯৫৫; আওয়ামী লীগ: ৪২,২৬৫;
(২৩) সিলেট — ৩: বিএনপি: ২৫,৯৫৪ + জামায়াত: ৬,৭৫৫ = ৩২,৯৮০ (এ আসনে জেপি প্রার্থী মাত্র ২৬,৬৫৯ ভোট পেয়ে জয়ী হন।
(২৪) সিলেট– ৫: বিএনপি: ৪,৮৬০ + জামায়াত: ২৮,১২০ = ৩২,৯৮০; আওয়ামী লীগ:২৯,৪৮৩ ;
(২৫) মৌলভিজাবার–১: বিএনপি: ২০,০৪৭ + জামায়াত: ৮,৯৫৮ = ৩৯,০০৫; আওয়ামী লীগ: ৩৩,১৭৮;
(২৭) ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া–৪: বিএনপি: ৩৮,৮১৪ + জামায়াত: ৭,৯১২ = ৪৬,৭২৬; আওয়ামী লীগ: ৪১,৬১৪ ;
(২৮) কুমিল্লা- ৬: বিএনপি: ৩৬,৭২৮ + জামায়াত: ২,১৫৭ = ৩৮,৮৮৫; আওয়ামী লীগ:৩৭,০৮৯ ;
(২৯) কুমিল্লা–বিএনপি:৪৯,৪৭৯ + জামায়াত:১৩,২৮৫ =৫৯,৯৬৪; আওয়ামী লীগ: ৪৯,২৯৮;
(৩০) চাঁদপুর –৫: ৬১,৮৯৩ + জামায়াত: ৬,৩১৯ =৬৮,২০২; আওয়ামী লীগ: ৬২,৩০৮;
(৩১) ফেণী–২: বিএনপি: ৬২,৬২৯ + জামায়াত:১১,৯১৬ =৭৪,৫৪৫; আওয়ামী লীগ: ৬৮,৫১১;
(৩২) চট্টগ্রাম –২: বিএনপি: ৪৩,১১৯ + জামায়াত: ৭,৪৮৮ = ৫০,৬০৭; আওয়ামী লীগ: ৪৫,৪৭৬;
(৩৩) কক্সবাজার–১ বিএনপি: ৫১,৪১৭ + জামায়াত: ২৭,৩২১ =৭৮,৭৩৮; আওয়ামী লীগ–৭২,৬৬৫;
(৩৪) কক্সবাজার–৪: বিএনপি: ৩০,৫৯৪ + জামায়াত: ১৭,৬০৮ = ৪৮,২০২; আওয়ামী লীগ: ৪৪,৭০৬;
(৩৫) জামালপুর — ২: বিএনপি: ৩৬,৩৪৪ + জামায়াত: ৭,০৮৮ তে=৪৩,৪৩২; আওয়ামী লীগ: ৪১,৮১৬;
(৩৬) ময়মনসিংহ –৬: বিএনপি: ৩২,১১৭ + জামায়াত: ১৭,৩৩৯ =৪৯,৪৫৬; আওয়ামী লীগ:
(৩৭)গাজীপুর–৩০,৮৩৪ + জামায়াত: ৫,৬০১ = ৩৬,৪৩৫; আওয়ামী লীগ: ৩৫,৪৯৯
(৩৮) নরসিংদি–৪: বিএনপি: ৭৭,৬২০ + জামায়াত: ৪,৩৯০ =৮১,০১০; আওয়ামী লীগ: ৭৮,৭২১
(৩৯) নারায়ণগঞ্জ–২: বিএনপি:৫৮,৩৮৮ + জামায়াত: ৩,২৫১ =৬১,৬৩৯; আওয়ামী লীগ: ৫৮,৯৪৭।
খুলনা –৬: আসনে বিএনপির ১৬,৮৩৫ ও জামায়াতের ৪৯,০৬৩ সম্মিলিত প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৫,৮৯৮ এবং আওয়ামী লীগ: ৬৬,০৩৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাত্র ১৬৩ ভোটে জয়ী হন। এমন বিস্ময়কর পরিসংখ্যান আরো আছে।
আমার কাছে সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার হলো, এত পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তির নড়বড়ে অবস্থা অনুধাবন না করেই কীভাবে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো! ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া–২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন সর্বসাকুল্যে ১৭০টি। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের আগে এমন আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করেছিলেন যে, সারা দেশের ভোটাররা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। “ধরণী দ্বিধা হও।” একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল মাঠ যাচাই না করে কীভাবে সারাদেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী দাঁড় করানোর করতে পারে? কুমিল্লা –১ আসনে জামায়াত ভোট পেয়েছিল ৫৪৪টি, বরগুণা ৩ আসনে জামায়াতের ভোট ৪৮০, মুন্সীগঞ্জ ৩ আসনে ৭৩৯, মুন্সীগঞ্জ ২ আসনে ৭০৮, মানিকগঞ্জ ৪ আসনে ৯৯৪, মুন্সীগঞ্জ ১ আসনে ৯৫৮ এবং ঝালকাঠি ১ আসনে ৯২৫ টি ভোট পেয়েছে। ১৫টি আসনে জামায়াতের প্রার্থীদের ভোটসংখ্যা ১০০০ থেকে ২০০০ এর মধ্যে।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত সীমিত সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট প্রদত্ত ভোটের ১১.৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, কিন্তু সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে অনেক কম ভোট পেয়েছে। মোট প্রদত্ত ভোটের ৮.১১ শতাংশ। তাহলে অর্জনটি কি ছিল?
যে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য অথবা বিএনপিকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল, ২০০১ সালে জামায়াত আবারও লেজ গুটিয়ে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছিল। বিএনপি বিজয় লাভ করেছিল এবং জামায়াত পেয়েছিল ১৭টি আসন। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত সরকারে যোগ দিয়েছিল। তারা বিএনপির সঙ্গে “বনিয়ানুম মারসুস
…