আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : পৃথিবীর সকল ফলের মধ্যে আম উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আমকে বলা হয় ফলের রাজা। জনপ্রিয় এই ফল উর্দু লেখক ও কবিদের মনোযোগ এড়িয়ে যায়নি। উর্দু সাহিত্য ও বিশেষ করে উর্দু কবিতা আমের মাহাত্ম ও কাহিনিতে পূর্ণ। এখানে আম সম্পর্কে বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবসহ কয়েকজন খ্যাতিমান উর্দু কবির কবিতাংশ তুলে ধরছি:
মির্জা গালিবের আম প্রীতি
আমের সঙ্গে জুড়ে আছে মির্জা গালিবের (১৭৯৭-১৮৬৯) নাম। আমের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল কিংবদন্তি তূল্য। এ সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। একবার তিনি আম খাচ্ছিলেন, তাঁর সাথে বসা ছিলেন তাঁর এক হাকিম বন্ধু রাজিউদ্দিন খান। হাকিম সাহেব হঠাৎ লক্ষ্য করেন যে একটি গাধা আবর্জনার স্তুপে খাবার খুঁজছে, কিন্তু আমের খোসা স্পর্শও করছে না। তিনি গালিবকে বললেন, “দেখুন, মির্জা সাহেব, এমনকি গাধাও আম পছন্দ করে না।” গালিব তাঁর বন্ধুকে মোক্ষম উত্তর দিতে বিলম্ব করলেন না। বন্ধুর কথার অনুকরণ করে বললেন, “ঠিকই বলেছেন, হাকিম সাহেব, কেবল কোনো গাধাই আম পছন্দ করে না।”
গালিবের আম প্রীতির ওপর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, একবার আমের মওসুমে গালিব বাহাদুর শাহ জাফরের (১৭৭৫-১৮৬২) সঙ্গে মোগল অভিজাতদের জন্য সংরক্ষিত শাহী উদ্যান ‘বাগ-ই-হায়াত বখশ’ যান। বাদশাহ লক্ষ্য করেন যে গালিব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আম পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি তাকে প্রশ্ন করেন যে তিনি কি খুঁজছেন। গালিব বাদশাহকে ফারসিতে
উত্তর দেন যে তিনি প্রবীণদের বলতে শুনেছেন:
বর সর-এ হর দানা বা নাবিস্তা আয়ান
কা-এন ফালান ইবন-এ-ফালান ইবন-এ-ফালান
( খাবারের প্রতি টুকরায় কেউ দেখতে পায় স্পষ্ট লেখা তার নাম,
এটা অমুকের জন্য, তার পুত্র অমুক ও তার পুত্র অমুকের জন্য।
গালিব বাদশাহকে বলেন যে, কোনো আমের ওপর তার পূর্বপুরুষের নাম লেখা আছে কিনা তিনি তা খুঁজছেন। বাদশাহ কবির ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সেদিন শাহী আম্রকাননের আম গালিবের কাছে পাঠানো ব্যবস্থা করেন। আম নিয়ে গালিবের আরেকটি কাহিনি আছে। এক মুশায়রায় আমের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করছিলেন কবিরা। উপস্থিত মাওলানা ফজল-এ-হক (১৯৯৭-১৮৬১) গালিবের কাছে তার মতামত জানতে চাইলে গালিব বলেন যে আমের দুটি গুণ থাকা উচিত:
“আমো মে বাস দো খুবিয়াঁ হোনা চাহিয়ে,
এক মিঠে হো, আউর বহুত সারে হো।”
(আমের মধ্যে দুটি গুণ থাকা উচিত।
মিষ্টি হতে হবে, এবং পরিমাণে বেশি হতে হবে।)
গালিবের বক্তব্য কারণ ছাড়া ছিল না। তিনি এমনকি আমের প্রশংসায় কবিতাও লিখেছেন, যার নাম “দর সিফাত-এ-আমবা”:
মুঝসে পুছো তুমহে খবর কিয়া হ্যায়,
আম কে আগে নেশক্কর কিয়া হ্যায়,
ইয়া ইয়ে হোগা কে ফরত-এ-রাফা’ত সে
বাগ বানো নে বাগ-এ-জান্নাত সে
আঁগাবিন কে বা হুকম-এ-রব-ইন-নাস
ভর কে ভেজে হ্যায় সর বা মোহর গিলাস।”
(আমাকে প্রশ্ন করো যে তোমার খবর কি?
ইক্ষুর চেয়ে আম অনেক বেশি মিষ্টি।
সম্ভবত ওপরের অনেক বেশি উচ্চতা থেকে
আল্লাহর হুকুমে বেহেশতের বাগানের মালীরা
আবদ্ধ পানপাত্রে মদিরা প্রেরণ করেছে।)
কলকাতায় অবস্থানকালে গালিব হুগলির ইমামবাড়ার মুতাওয়াল্লিকে লেখেন, “আমি যে কেবল আমার উদরের দাস, তাই নয়, আমি মানুষ হিসেবেও দুর্বল। জ্ঞানী ব্যক্তিরাই জানেন যে, এ দুটি অবস্থাকেই পরিতৃপ্ত করতে পারে শুধু আম।” আমের মওসুম শেষ হওয়ার আগে তাঁকে দুই তিনবার স্মরণ করার জন্য তিনি মুতাওয়াল্লিকে অনুরোধ করেন। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও আমের জন্য তাঁর ক্ষুধা চাঙ্গা ছিল। ষাট বছর বয়সে তিনি তার বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, এখন তিনি আর এক বসায় “দশ থেকে বারোটির বেশি আম খেতে পারেন না,” এবং “আমের আকার বড়ো হলে মাত্র ছয় সাতটি” খেতে পারেন। তিনি আফসোস করে লেখেন, “হায়, যৌবনের দিনগুলো অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বাস্তবিক পক্ষেই জীবনের দিনগুলো শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।”
আমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কবি আকবর এলাহাবাদীর (১৮৪৬-১৯২১) বেশ কিছু কাহিনি আছে। একটি হলো, একবার তিনি কবি আল্লামা ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) জন্য এলাহাবাদ থেকে এক ঝুড়ি ল্যাংড়া আম লাহোরে কবির কাছে পাঠান। কবি
ইকবাল আম পাওয়ার পর তাকে জানাতে এই কবিতাটি লিখেন:
“আসর হ্যায় তেরি এ্যয়জাজ-এ-মসিহায়ে কা এ্যয় আকবর
এলাহাবাদ সে ল্যাংড়া চলা লাহোর তক পহুচা।”
(আকবর, এটা তো হযরত ঈসা’র মতো অলৌকিক ঘটনা,
ল্যাংড়া (খোড়া) এলাহাবাদ থেকে লাহোরে পৌছে গেছে।)
আকবর এলাহাবাদী অত্যন্ত রসিক কবি ছিলেন। আমের ওপর তার পুরো একটি কবিতা আছে “আম নামা”। তিনি তার বন্ধুকে বলছেন এলাহাবাদে তার জন্য আম পাঠাতে। কবিতার প্রতিটি লাইনে আমের প্রতি তার দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে:
“নামা না কোঈ ইয়ার কা পয়গাম ভেজিয়ে,
ইস ফসল মে জো ভেজিয়ে বাস আম ভেজিয়ে,
এ্যয়সা জরুর হো কে উনহে রাখ কে খা সাকুঁ
পুখতা আগার বিস তো দস খাম ভেজিয়ে
মালুম হি হ্যায় আপ কো বান্দে কা পাতা
সিধে এলাহাবাদ মেরে নাম ভেজিয়ে
এ্যয়সা না হো কে আপ ইয়ে লিখেঁ জওয়াব মে,
তামিল হোগি হুকম পেহলে মগর দাম ভেজিয়ে।”
(হে প্রিয়, আমার কাছে কোনো খবর পাঠিয়ো না,
এই মওসুমে কিছু পাঠাতে হলে কেবল আম পাঠাও।
আমগুলো যাতে এমন হয় যে রেখে খেতে পারি,
পাকা আম যদি বিশটা হয়, তাহলে দশটা কাঁচা দিয়ো,
আমার ঠিকানা তো তুমি নিশ্চয়ই জানো,
আমার নামে সোজা এলাহাবাদে পাঠিয়ে দাও,
আমার চিঠির উত্তরে তুমি এমন কিছু লিখো না যে
আদেশ অবশ্যই পালিত হবে, প্রথমে দাম পাঠাও।)
আরও অনেক কবি ফলের রাজা আমের প্রতি তাদের ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন। কবি মুনাওয়ার রানা (১৯৫২-২০২৪) তার এক কবিতায় বলেছেন যে আমের মওসুমে তিনি অন্য কোনো ধরনের মিষ্টি খান না:
“ইনসান কে হাথোঁ কি বানায়ি নেহি খাতে
হাম আম কে মওসুম মে মিঠাই নেহি খাতে।”
(আমি মানুষের হাতের বানানো কিছু খাই না,
আমের মওসুমে আমি আর কোনো মিষ্টি খাই না।)
আমের প্রতি কবি মির্জা গালিবের দুর্বলতার সঙ্গে কবি মুনাওয়ার রানা আমের প্রতি তার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন তার কবিতায়:
“আল্লাহ জানতা হ্যায় মুহব্বত হামি নে কি,
গালিব কে বাদ আমো কি ইজ্জত হামি নে কি।”
(আল্লাহ জানেন, আমি প্রেমের শর্ত পূরণ করেছি
গালিবের পর আমিই আমের মর্যাদা দিয়েছি।
ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের কবি আখতার শিরানি (১৯০৫-১৯৪৮) আবেগমথিত ভাষা আমের ওপর একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতায় তিনি প্রবাস জীবনে দেশ থেকে দূরে কাটালেও আমের মওসুমে আম না পাওয়ার মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন তার কবিতায়:
“ও দেস সে আনে ওয়ালে, বাতা,
কিয়া আম কে উঁচে পেরো পর
আব ভি ও পাপিহে বোলতে হ্যায়,
শাখোঁ কে হরিরি পর্দো মে
নাগমো কে খাজানে ঘোলতে হ্যায়
সাওয়ান কে রসিলে গীতোঁ সে
তালাব মে আমরস ঘোলতে হ্যায়
ও দেস সে আনে ওয়ালে বাতা।
(দেশ থেকে যারা এসেছো, বলো,
আম গাছের সেই উঁচু ডালে কি
এখনও সেই কোকিলেরা গান গায়?
ডালের ঘন সবুজ পর্দার আড়ালে কি
গানের সুরের জাদু ছড়িয়ে পড়ে?
শ্রাবণ মাসের মধুর গানে কি
পুকুরে কি আমের রস মিশে যায়?
দেশ থেকে যারা এসেছো, বলো।)
ভারতের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে আম যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতিফলন দেখা যায় ব্যঙ্গরসের সেরা উর্দু কবি সাগর খায়ামি (১৯৩৮-২০০৮) লিখেছেন:
“আম, তেরি ইয়ে খুশনসিবী হ্যায়,
বরনা ল্যাংড়ো পে কৌন মরতা হ্যায়।”
(ওহে আম, এটা তো তোমার সৌভাগ্য,
তা না হলে কে ল্যাংড়াকে ভালোবাসতো?)